বিজ্ঞান সাধক আচার্য্য মেঘনাদ সাহাকে শ্রদ্ধাঞ্জলী

সুস্মিত মিশ্র

ভারতীয় বিজ্ঞান জগতের অন্যতম স্মরণীয় নাম মেঘনাদ সাহা।১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর তাঁর জন্ম।এই টুকু বললে এই মহান মানুষটার কীর্তির সঠিক ব্যাখ্যা করা হবে না,বরং কয়েক আলোক বর্ষের ফাঁক থেকে যাবে।কারন মেঘনাদের বন্ধুরাই তাকে বলতেন ‘আইগেনসাফটেন’। এটা একটা জার্মান শব্দ।এটাকে ইংরাজিতে বলা যেতে পারে ‘ইনভিন্সিবল’।আর বাংলায় বলতে পারেন "অজেয়"। 

বর্তমান বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার  কালিয়াকৈর উপজেলার অন্তর্গত শেওড়াতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম জগন্নাথ সাহা ও মাতার নাম ভুবনেশ্বরী সাহা। তিনি ছিলেন পঞ্চম সন্তান।তার পিতা ছিলেন পেশায় মুদি।অন্ত্যজ শ্রেণির পরিবার। অর্থাৎ নিচু জাত।

গ্রামের টোলে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন।এরপর তিনি শেওড়াতলী গ্রাম থেকে সাত মাইল দূরে শিমুলিয়ায় মধ্য ইংরাজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।তিনি শেষ পরীক্ষায় জেলার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে বৃত্তি পান।

এরপর ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। সেই সময় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে ঘিরে সারাবাংলা উত্তাল হয়েছিল। তাদের বিদ্যালয় পরিদর্শনের জন্য  গভর্নর বামফিল্ড ফুলার আসলে মেঘনাথ সাহা ও তার সহপাঠীরা বয়কট করায় বিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হন এবং তার বৃত্তি নামঞ্জুর হয়ে যায়।পার্শ্ববর্তী কিশোরীলাল জুবিলি হাই স্কুলের একজন শিক্ষক স্বঃপ্রণোদিত হয়ে তাকে তাদের স্কুলে ভর্তি করে বিনা বেতনে অধ্যয়নের ব্যবস্থা করেন। সেখান থেকেই তিনি ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ববঙ্গের সমস্ত বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় মাসিক ৪ টাকার সরকারি বৃত্তি সহ উত্তীর্ণ হন। এই পরীক্ষায় গণিত এবং ভাষা বিষয়ে তিনি সর্বোচ্চ নম্বর অধিকার করে।

১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে গণিতে অনার্স নিয়ে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। প্রেসিডেন্সি কলেজে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নিখিলরঞ্জন সেন, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শৈলেন্দ্রনাথ গুহ, সুরেন্দ্র নাথ মুখার্জী প্রমূখ তার সহপাঠী ছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে সংখ্যাতত্ত্ব বিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ এক বছরের এবং রসায়নবিদ নীলরতন ধর দুই বছরের সিনিয়র ছিলেন। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১৩ সালে গণিতে সম্মানসহ স্নাতক এবং ১৯১৫ সালে ফলিত গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। উভয় পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রথম হন।

অদ্ভুত এক লড়াকু মানুষ এই মেঘনাদ সাহা। 
সাহা এবং বসু নিজেদের নাম চিরস্থায়ী করে ফেললেন ১৯১৫ সালে জার্মান ভাষায় প্রকাশিত আইনস্টাইনের ‘সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব’-এর ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশ করলেন। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর বলেন, এটি একটি চমকপ্রদ ঘটনা।

১৯১৭-১৮ সালের মধ্যে ছয়টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় সাহার। তার ভিত্তিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি লাভ করেন। আর পরের বছরই পৃথিবীর জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাসে সাহার যুগান্তকারী আবিষ্কারের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। ‘তাপীয় আয়নন তত্ত্ব’ নামে পরিচিত এই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে ফিলজফিক্যাল পত্রিকায়। মেঘনাদ সাহার বয়স তখন মাত্র ২৭ বছর।

১৯২৭ সালে এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকাতে স্যার আর্থার এডিংটন লিখছেন ১৫৯৬ সাল থেকে ‘তারা’ সম্পর্কিত যত গবেষনা তার মধ্যে সেরা বারোটার মধ্যে সাহার গবেষণা অন্যতম। ১৯৩৬ সালে শ্যেন রোসেল্যান্ড লিখছেন “যদিও বোরকে জ্যোতির্বিদ্যার পথিকৃৎ বলে ধরা হয়, কিন্তু জ্যোতির্বিদ্যার প্রথম নির্ভরযোগ্য তত্ত্ব আবিষ্কার করেন ভারতীয় বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। … ভবিষ্যতের সমস্ত আবিষ্কারই সাহার তত্ত্বকে ধরেই এগিয়েছে।”

সাতবার মেঘনাদ সাহা নোবেল পুরস্কারের জন্য অনুমোদন পান। কিন্তু শিকে ছেঁড়েনি। একমাত্র রয়্যাল সোসাইটির সভ্যপদ ব্যতিরেকে দেশি বিদেশি আর কোনও সম্মান জোটেনি।

১৯৩১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইউপি অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’, যা ভবিষ্যতে হবে ‘ন্যাশনাল অ্যাকাদেমি অব সায়েন্সেস’।১৯৩৩ সালে মেঘনাদ সাহার উদ্যোগে কলকাতায় গঠিত হয় ‘ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি’।ভারতে পরমাণু পদার্থবিদ্যা গবেষণার জনকও মেঘনাদ সাহা। তিনি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়র ফিজিক্স যা পরে হবে সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়র ফিজিক্স। ১৯৩৮ সালে সাহা নদীবিষয়ক পৃথক গবেষণাগার তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। ১৯৪৮ সালে সাহার প্রস্তাব ও পরিকল্পনামাফিক দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন তৈরি হয়।
গান্ধির খাদি, চরকা ও শিল্পনীতির ঘোর বিরোধী, জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে অম্লমধুর সম্পর্ক, বয়সে ছোট সুভাষ বসু সম্পর্কে প্রগাঢ় ভালবাসা ও শ্রদ্ধা পোষণ করতেন মেঘনাদ সাহা।ভারতের বিজ্ঞান চর্চার সঙ্গে বিশ্বের পরিচয় ঘটিয়ে দেবার ব্যাপারে এবং ভারতের বিজ্ঞান গবেষণাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার ব্যাপারে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার অবদান অনস্বীকার্য।

জাতিভেদের বিরূদ্ধে আজীবন লড়াই করেছেন।যার ছাপ পড়েছিল তাঁর বিজ্ঞান গবেষণা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মতাদর্শে।তাই পিতৃদত্ত নাম পর্যন্ত বদলে নিয়েছিলেন।

সাহা জন্মের দিন প্রচণ্ড ঝড়-জলের তাণ্ডব হয়েছিলো। আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী ঝড়-জলের দেবতা দেবরাজ ইন্দ্র। তাই তাঁর নামানুসারে নবাগত শিশুর নাম রাখা হয়েছিল মেঘনাথ। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের বৈদিক ধর্মীয় আচরণের গোঁড়ামি মেঘনাথকে এতটাই বিরক্ত করে তুলেছিল যে, তিনি নিজের নাম পাল্টে রেখেছিলেন মেঘনাদ। যিনি ইন্দ্রজিৎ। দেবতা নন, রাক্ষসদের প্রতিনিধি। 
শুধু বিজ্ঞান বা রাজনৈতিক মতাদর্শ নয়, নিজের নাম বদলেও মেঘনাদ প্রমাণ করেছিলেন তিনি আসলে ডেমোক্র্যাটিক ক্লাসের প্রতিনিধি, যাদের পিছিয়ে পড়া বলা হয়, জোর করে পিছিয়ে রাখা হয়।

হে আচার্য এখন সংবাদ পরিবার নত মস্তকে আপনাকে জানায় শত কোটি প্রণাম

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন