মেহনতি মানুষের যুদ্ধের কান্ডারি সৌম্যেন্দ্র নাথ ঠাকুরকে শ্রদ্ধাঞ্জলী।


                                        সুস্মিত মিশ্র

বীন্দ্রনাথের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে যিনি জন্মেছিলেন তিনি জোড়াসাঁকোর এসথেটিক দুর্গে ফাটল ধরিয়ে রাজনীতির পথে নেমেছিলেন।অঁদ্রে জিদ-পল ভালেরি-অঁদ্রে মালরো’র মতো অগ্রণী চিন্তানায়কেরা তাঁর সাথে চিন্তাবিনিময় করতে আনন্দ পেতেন, আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে জিওনিজমের বিরোধিতায় যুক্তি সহ আলোচনা করতে পিছপা হননি,ফ্যাসিজিমের বিরুদ্ধে দুনিয়াজোড়া লড়াইয়ে অঁরি বারবুস আস্থা রেখেছিলেন এদেশের তরুন তুর্কি সাম্যবাদী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপরে। 

সৌম্যেন্দ্র নাথ ঠাকুর কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সন্তান। মা চারুবালা দেবী ঢাকার বিখ্যাত নবকান্ত চট্টোপাধ্যায়ে কন্যা। পিতা সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রপিতামহ ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। যদিও সাম্যবাদী ও মানবতাবাদী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে চিরকাল ঠাকুর পরিবারের ব্যতিক্রমী পুরুষ হিসেবে পরিচিত হয়েছেন তিনি। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের পরেই আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে বাঙালী হিসেবে সৌম্যেন্দ্রনাথ সমধিক আলোচিত ব্যক্তিত্ব। 


কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো ও রুশ বিপ্লব সম্পর্কিত বইপত্র পাঠ করে এবং কাজী নজরুল ইসলাম, মুজফ্‌ফর আহ্‌মেদের সাহচর্যে তিনি কমিউনিজমে দিকে অগ্রসর হন। বাগ্মী হিসেবে তার ভারতজোড়া খ্যাতি ছিল। তারই কৃত প্রথম কমিউনিস্ট ইস্তেহারের বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয় কবি নজরুল সম্পাদিত 'লাঙল' পত্রিকায়।

নিজের জীবনে বহু সামাজিক বিদ্রোহে ব্রতী হয়েছেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্রথম পৈতে নিতে অস্বীকার করেন। বাড়িতে বোমা তৈরির কারখানা করেন, তখন অবশ্য বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত। সারারাত সঙ্গীদের সঙ্গে বোমা বাঁধছেন, আবার দিবাভাগে রবীন্দ্রনাথের কাছে যাচ্ছেন গানের মহড়ায়! একমাত্র কমিউনিস্ট নেতা যিনি পূর্বজীবনে গান্ধীজির প্রভাব এবং দেশের গণজাগরণে গান্ধীজির অবদান মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করেছেন। শ্রমিক-কৃষক দলের সাহায্যার্থে সৌম্যেন্দ্রনাথ-আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ-ই প্রথম প্রকাশ্য মঞ্চে ‘ভদ্র পরিবারে’র কোনও মেয়ে নৃত্যে অংশ নিলেন।এরও কিছুদিন পর ‘নটীর পূজা’য় রবীন্দ্রনাথ মেয়েদের যুক্ত করেন।

সৌমেন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের এক ব্যতিক্রমী উত্তরসূরি। ইতিহাসে তাঁর জায়গাটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এবং তার সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে। জমিদার বাড়ির আভিজাত্য থেকে বেরিয়ে এসে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন একেবারে মেহনতি মানুষের যুদ্ধে।তাঁর লেখা বিভিন্ন বই ব্রিটিশ সরকারকে ভাবিয়ে তোলে।১৯৩০ সালে সৌম্যেন্দ্রনাথের ‘বিপ্লব বৈশাখী’ নামে একটি বার্লিন থেকে প্রকাশিত হয়,কিছুদিনের মধ্যেই বাজেয়াপ্ত করা হয় বইটি। শুধু তাই নয়, এরপর সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার উপর কড়া দৃষ্টি রাখতে শুরু করে বেঙ্গল গভর্নমেন্ট। পরের বছর ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বইটি প্রকাশিত হলে সঙ্গে সঙ্গে বাজেয়াপ্ত হল। কিন্তু তারপরেও লেখা বন্ধ করলেন না সৌমেন্দ্রনাথ। ১৯৩২ সালে আবার লিখলেন ‘লাল নিশান’।ভীত ইংরেজ শাসক সাথে সাথে বাজেয়াপ্ত করে এই বইটাও।
মূল ধারার কমিউনিস্টদের মতো আগে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পরে সমাজতন্ত্র, এই ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন না সৌমেন্দ্রনাথ। তাই তাঁর কাছে কংগ্রেস মানে জমিদারদের দল। আর সেই দলের হাত ধরে দেশে শ্রমিক-কৃষকের ক্ষমতায়ন সম্ভব নয় বলেই মনে করতেন তিনি। তবে কংগ্রেস নেতৃত্বের বিরোধিতার করলেও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড শুরু করার ডাক দিচ্ছিলেন তিনি। তাই ব্রিটিশের কাছে তিনি ছিলেন আশঙ্কার কারণ ।


বাংলা বইগুলি ছাড়াও অসংখ্য ইংরেজি বই লিখেছেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কখনও হিটলারের জার্মানি সম্বন্ধে, কখনও আন্দামানের ভারতভুক্তি সম্বন্ধে। এছাড়াও লিখেছেন চট্টগ্রামে মাস্টারদার নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে। বস্তুত মাস্টারদা এবং চন্দ্রশেখর আজাদের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তিনি। এবং সেইসমস্ত বিষয় নিয়ে লেখা প্রায় সমস্ত বইই ব্রিটিশ আইনে নিষিদ্ধ হয়েছে। আজ তাঁর অধিকাংশ বইয়ের কোনো কপি পাওয়া যায় না। ব্রিটিশ সরকার যেগুলো পেরেছে নষ্ট করেছে। আর বাকিটা নষ্ট করেছেন তাঁর দল বলতে সিপিআই, আরসিপিআই দলের সদস্যরা।
সামাজিক আন্দোলনে তিনি জড়িত থাকতেন নিরন্তর। তাঁর উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল বহু গ্রন্থাগার, হয়তো সংখ্যায় তা হাজারেরও বেশি। বহু স্কুল, উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠান স্থাপনেও ওঁর সক্রিয় উদ্যোগ কাজ করেছে। সমবায় আন্দোলন নিয়ে নিজে অসম্ভব উৎসাহী, বিশেষ করে কৃষি-সমবায়ে। ব্যক্তিগত ভাবে বিভিন্ন গ্রামে জমি কিনে কৃষি-সমবায়, কৃষি-কমিউন গড়ার চেষ্টা চালিয়েছেন। সৌম্যেন্দ্রনাথের মতো বহুকৌণিক ব্যক্তিত্বের ১৯৭৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর প্রয়ান হয়।

গুণী এই মানুষটিকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানায় এখন সংবাদ পরিবার

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন