বাংলার পূর্ণ সময়ের একমাত্র বাঙ্গালী রাজ্যপাল ডঃ হরেন্দ্র কুমার মুখার্জীকে শ্রদ্ধাঞ্জলী

                                                সুস্মিত মিশ্র

ভোরবেলা রাজ্যপালের হাঁটতে বেরোনোর অভ্যাস। এক শীতের সকালে রাজভবন থেকে বেরোতে গিয়ে তিনি দেখলেন লিফটম্যান সারা রাত ডিউটি করে লিফটের পাশেই ঘুমিয়ে পড়েছে ।এই দৃশ্যটি দেখে তিনি আবার ঘরে ফিরে গেলেন।ঘরে গিয়ে একটা শাল নিয়ে এসে চুপিসাড়ে লিফটম্যানের গায়ে জড়িয়ে দিয়ে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে গেলেন রাজ্যপাল! পরে ঘুম ভাঙ্গার পিরে লিফটম্যান ঘুমিয়ে পড়ার জন্য, রাজ্যপালের কাছে গিয়ে করোজোড়ে ক্ষমা চেয়ে শাল ফেরত দিতে গেলে তিনি সস্নেহে তাকে বলেছিলেন, "ছোট ভাইকে দেওয়া উপহার ফিরিয়ে নিতে নেই! তিনি এই বাংলার এক মাত্র পূর্ন সময়ের বাঙ্গালী রাজ্যপাল ডঃ হরেন্দ্র কুমার মুখার্জী।

১৮৮৭ সালের ৩ অক্টোবর কলকাতায়  সম্ভ্রান্ত  বাঙালি ক্রিশ্চিয়ান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ডঃ হরেন্দ্র কুমার মুখার্জী। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার রিপন কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে রিপন কলেজ থেকে এফ.এ এবং ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরাজীতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম.এ পাশ করেন। এরপর সিটি কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা ও বরিশাল রাজচন্দ্র কলেজ ও কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইংরাজীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় হিসাবে পিএইচডি লাভ করেন।পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিভাগের তিনি প্রধানও হয়েছিলেন! এই বিশ্ববিদ্যালয়তেই আরও নানা পদে ছিলেন তিনি।

জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম সদস্য ছিলেন। একসময় স্বাধীনতার মাহেএল দেশ। স্বাধীন একটি দেশের জন্য তো স্বতন্ত্র নিয়ম চাই, আইন চাই। শুরু হল সংবিধান তৈরির কাজ। তৈরির করা হল ড্রাফটিং কমিটি। সেই কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি অফ ইন্ডিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হয় হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়কে। এছাড়াও মাইনরিটি রাইটস সাব-কমিটির চেয়ারম্যান পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি। পরে, ভারত স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের পদে বসেন তিনি। ১৯৫১ সালের ১ নভেম্বর রাজ্যের তৃতীয় এবং প্রথম বাঙালি রাজ্যপাল হিসেবে কাজ শুরু করেন ডঃ হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়।


১৯৫২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি, কলকাতার ইডেন গার্ডেনসে ভারত সরকারের তরফ থেকে প্রথমবার আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সূচনা হয়। সেই প্রথম চলচ্চিত্র উৎসবের প্রধান বক্তা ও উদ্বোধক ছিলেন রাজ্যপাল ডঃ হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়।

হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়ের সাদাসিধা জীবন যাপন ছিলো। যেটুকু দরকার না হলেই নয়, সেটুকু নিয়ে থাকতেন। যা রোজগার করেন, সবই দান করে দেন। অধ্যাপক থাকাকালীনই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথমে তিন লাখ, পরে আরও এক লাখ টাকা দান করেন । এছাড়াও যখন তিনি সেখানকার ইন্সপেক্টর, তখনও খ্রিস্টান যুবকরা যাতে ঠিকঠাক শিক্ষা পায়, অসুবিধা না হয় সেটা দেখতেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের বাবা-মা’র নামে একটি ফান্ডও তৈরি করেন। প্রথমে দুই লাখ, পরে আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা সেখানে দেন।

রাজভবনের বিলাসব্যসন এই রাজ্যপাল শূন্যে নামিয়ে এনেছিলেন।  যারা তখন রাজভবনের অতিথি হয়ে বাইরে থেকে এখানে আসতেন, সেই অতিথিদের কেউ কেউ দিল্লি ফিরে গিয়ে সরাসরি নেহেরুর কাছে নালিশ করতেন,এই রাজ্যপালের কাছ থেকে অতি সাধারণ আতিথেয়তা পেয়ে। রাজভবন ছেড়ে চলে যাবার সময় রাজ্যপালের আতিথেয়তা ফান্ডে আট লক্ষ টাকা জমিয়ে রেখে গেছিলেন ডঃ হরেন্দ্র কুমার মুখার্জী।রাজ্যপাল হিসাবে তখন মাইনে পেতেন ৫০০০ টাকা।৫০০ টাকা নিজের ও পরিবারের জন্য রেখে, বাকিটা তিনি দুঃস্থদের এবং টিবি রোগীদের চিকিৎসায় দান করে দিতেন।

১৯৫৬ সালের আগস্টে মারা যান রাজ্যপাল ডঃ হরেন্দ্র কুমার মুখার্জী।মারা যাওয়ার আগেও, নিজের সারা জীবনের সঞ্চয় ১৭ লাখ টাকা দিয়ে যান তাঁর সাধের প্রতিষ্ঠান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ।এক প্রকার নিঃস্ব হয়েই তাঁর মৃত্যু হয়।

আদ্যোপান্ত এক নিপাট সৎ নির্ভীক বাঙালী ।এত বিশাল জায়গায় গিয়েও মনটা তাঁর মাটির দিকেই পড়ে থাকতো।পড়ে থাকতো মাটির মানুষের কাছে। যেমন স্বভাব, তেমন ব্যক্তিত্ব, তেমনই ছিল তীক্ষ্ণ মেধা।এই রকম একজন আমাদের রাজ্যপাল ছিলেন ভাবলে বুকটা গর্বে ভরে যায়।এখন সংবাদ পরিবার এই মহান মানুষটিকে জানায় সশ্রদ্ধ প্রণাম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন