।। অবাঞ্ছিতার বাঞ্ছা ।।

  তাসনূভা ঝিনুক দুপুর বেলা সবে চোখটা লেগে আসছিল। দরজায় খুট করে শব্দ হতেই চোখ মেলে দেখি রতন নামের নতুন ভৃত্যটা ঘরে ঢুকছে। অবশ্য ইদানীং সে হুটহাট দরজা খুলে ঘরে ঢুকে যায়। রাগ হচ্ছে ভীষণ, কিন্তু কিছু বলতেই পারছি না। বললেও সে শুনে না, অবশ্য শোনার কথাও না। আমার কথা কে-ই বা শুনেছে কবে? 
রতন এ বাড়ির ভৃত্য। আমার দাদার আমলের এই বিশাল জমিদার বাড়ি একসময় আমাদের ছিল। এখন হয়তো হাতবদল হয়ে গেছে। বাড়ির বর্তমান মালিক বাড়ি দেখাশোনার জন্য ওকে রেখেছেন ।  
আমার নাম মৃন্ময়ী রায়চৌধুরী। আমার দাদার বাবা ত্রিলোক নাথ রায়চৌধুরী ছিলেন বনেদি জমিদার। দৌর্দণ্ড প্রতাপশালী এই জমিদারের ভয়ে এই তল্লাটে বাঘে ছাগে এক ঘাটে জল খেত। আমার বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীর আমলে অবশ্য সেই জমিদারি জৌলুশ খুব একটা না থাকলেও আত্মম্ভরিতা এবং মেজাজ আকাশচুম্বী ছিল। ত্রিলোক নাথের কোনো কন্যা সন্তান বেঁচে ছিল না। শোনা যায় তার ঔরশজাত কন্যা সন্তানদের নাকি তিনি আঁতুড়ঘরেই মেরে ফেলতেন। তার চার পুত্র সন্তানের মধ্যে আমার দাদা শম্ভুনাথ রায় চৌধুরীই মোটামুটি দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন। তার অন্যান্য ভাইয়েরা শিশু অবস্থায় মারা যায়। শম্ভুনাথের পাঁচ পুত্র, কোনো কন্যা সন্তান ছিল না। আমার কাকাদের কারো ঘরে কোনো কন্যা সন্তান জন্মায়নি। বাবা কাকাদের সবমিলিয়ে আট পুত্র। শুধুমাত্র আমার বাবার ঘরে এই বংশের কয়েক পুরুষ পর এসে একমাত্র জীবিত কন্যা সন্তান ছিলাম আমি। আমার মায়ের প্রবল বাঁধার মুখে আমি বেঁচে গিয়েছিলাম,নয়তো আমারও পরিণতি এই বংশের অন্যান্য কন্যা শিশুর মতোই হতো। 
এ বাড়িতে আমার ভাই এবং কাকাতো জেঠাতো ভাইদের জন্য একরকম নিয়ম ছিল, আমার জন্য নিয়ম ছিল আরেক রকম। বাবা কাকাদের একটা নিয়ম ছিল ভোরবেলা ওঠে স্নান সেরে বাড়ির সমস্ত পুরুষ জেঠামশাই কে গড় হয়ে প্রণাম করতো। জেঠামশাই রাশভারী মানুষ। আমারও খুব ইচ্ছে করতো কিন্তু আমার নিষেধ ছিল। জেঠা মশাই আমাকে দেখলেই কেন যেন প্রবল ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিতেন। তাকে শুধু পূজা পার্বণের সময় তার দরজার বাইরে থেকে প্রণাম করা যেত। তা-ও তার মুখে বিতৃষ্ণার ছাপ স্পষ্ট থাকতো তখন। আমার বাবার আমার প্রতি ভালোবাসা বা ঘৃণা কোনোটাই স্পষ্ট বোঝা যেত না।
আমার নুপুর পরা বারণ ছিল৷ কারণ আমার পায়ের নুপুরের শব্দে বাড়ির পুরুষদের অমঙ্গল হবে। ঋতুমতী দিন গুলোতে আমার নিজ কামরার চৌকাঠ পেরুনো নিষেধ৷ আমার বাবাদের সময়ে আমাদের বংশের জমিদারি প্রায় বিলুপ্ত। বাবা কাকারা চাকরি বা ব্যবসায় নিয়োজিত ছিল। আমার মা আর ছোট কাকির সাহায্যে আমার কিছুটা অক্ষর জ্ঞান হলো। ছোট কাকি আমাকে নিজের বিদ্যা উজার করে দিয়েছিলেন। দশ বছর বয়সেই আমি গড়গড় করে বাংলা বই পড়তে পারতাম। এই পড়াই আমায় শিখিয়ে ছিল যে আমার বাবা কাকারা এই বাড়ি চৌহদ্দির মধ্যে যে আচরণ আমার সাথে করে, তা বাইরের পৃথিবীতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর সেদিনের সেই রাতের ঘটনা তো আরও গর্হিত অপরাধ ছিল।
তখন আমার বয়স পনেরো ছুঁই ছুঁই। উপযুক্ত পণের অভাবে বনেদি ঘরের পাত্র জুটছে না। যারা কম পণে আসছে তারা আবার দোজবরে অথবা বিপত্নীক, নয়তো একেবারে অশীতিপর বৃদ্ধ। মান সম্মানের কারণে এদের কাউকে বিয়ে দিতে পারছে না আবার পণও জোগাড় হচ্ছে না। এদিকে আমার বয়সও বেড়ে যাচ্ছে বলে বাবা রোজ আফসোস করে। শাস্ত্রে নাকি আছে রজঃস্বলা কন্যাকে কুমারী দেখা ব্রাহ্মণের জন্য মৃত্যু স্বরূপ। 
কিন্তু তারপরও শেষ রক্ষা হলো না। সেদিনের সেই ঘটনার প্রভাব পুরো রায়চৌধুরী বংশের ভুগতে হচ্ছে এখনো পর্যন্ত। যাইহোক সেসব এখন ম্যালা দিন গত হয়ে গেছে। কী থেকে কত কথা বলে বসলাম। যাই, দেখি রতনা ছোঁড়া করছেটা কি? 
ওমা! সে তো দেখি এই অবেলায় আবার ঝাড়পোঁছ করছে। কেউ আসছে নাকি এ বাড়িতে?  
অবশ্য এলেও তেমন কোন সুবিধা হবে না, ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দেব সবকটা কে।
আমার দাদার আমলে তৈরী বাড়িটা তেমন পুরোনো না হলেও বাড়ীটা সংস্কার হয়েছে । সেদিনের সেই ঘটনার কিছুদিন পরে পুরো রায়চৌধুরী পরিবার এই বাড়ি ফেলে চলে যেতে বাধ্য হয়। তখন থেকে আমি একাই পাহারা দিচ্ছি এই বাড়ি। 
এই তো বছর কতক আগেই দেখলাম ছোটকা' র বড় ছেলে যাকে আমি কুটুস বলে ডাকতাম জনাকতক লোক নিয়ে এই বাড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালো। ছোট কাকির কারণে এই ভাইটা আমার আশেপাশে এলেও আমি তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাই না। ভাইগুলো কেমন যেন বুড়িয়ে গেছে। অবশ্য বয়সও তো কম হলো নাহ। এই কুটুসটাও প্রায় সত্তর পার করে ফেলেছে।
মনেহয় ওরা বাড়িটা বিক্রি করতে চাচ্ছে । অবশ্য ওদের এখন যা অবস্থা, এ বাড়ি বিক্রি করা অসম্ভব কিছু নাহ।
বিকেল গড়াতেই একটা গাড়ি এসে থামলো বাড়ির গেটে। গাড়ি থেকে প্রথমে নামলেন একটি বিশ বাইশ বছরের মেয়ে। কোমর ছাপানো লম্বা চুলের মেয়েটির গায়ের রঙ গমের মতো, মুখশ্রী যেন সাক্ষাৎ প্রতিমা। তার পিছনে পিছনে নামলো বোরকা পরা এক মধ্যবয়সী মহিলা, তারপরে ষাটোর্ধ একজন পুরুষ। তাদের সাথে আরও দুটো বছর পনেরোর ছেলে। দেখে মনে হচ্ছে যমজ। 
গাড়ি থেকে নামতেই ছেলেগুলো হৈহৈ করে ঘরে ঢুকতে চাইলেই তাদের বাবা জোরে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললেন, খবরদার! তোরা কেউ ঢুকবি না এখন। প্রথমে প্রিয়তা এই বাড়িতে ঢুকবে,সাথে তোদের মা। বাড়িতে প্রথম বাড়ির লক্ষীর পা পড়তে হয়। তবেই গৃহস্থের মঙ্গল। 
কথাটা শুনেই বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে ওঠল। আহা! এমন বাবাও পৃথিবীতে হয়? এমন পুরুষ পৃথিবীতে হয়!!
আমাদের বাড়ির মেয়েদের তো প্রায় অচ্ছুৎ ভাবা হতো। মাকে আমি কখনোই দেখিনি কোনো শুভ কাজ পুরুষদের আগে করতে। 
পরক্ষণেই ভাবলাম সে যাইহোক এ বাড়িতে ওদের ঠাঁই হবে না। আমি হতেই দিব না। 
প্রিয়তার বাবার নাম আজাহার আলী। পেশায় ব্যবসায়ী। আজাহার সাহেব ঘরে ঢুকেই সবাইকে বললেন, আগে পুরো ঘর ঘুরেফিরে দেখো, তারপর নিজের ঘর বেছে নাও। এই বাড়িতে সবমিলিয়ে চৌদ্দ কামরা। প্রথমে প্রিয়তা তার ঘর পছন্দ করবে। সবাই ঘুরে ঘুরে বাড়িটা দেখছে। এ বাড়ির সিঁড়ি ঘরটি উত্তরদিকে। তিন তলা এ বাড়ির তৃতীয় তলায় ঠাকুরঘর এবং এর লাঘোয়া কয়েকটি ঘর ছাড়া বাকি অংশ খোলা ছাদ। আমার ঘরটা বাড়ির দোতলায় সর্ব দক্ষিণে। এই ঘরটা আমাকে দেয়া হয়েছিল যাতে বাড়ির কারও বের হওয়ার সময় আমার মুখ দেখে যেতে না হয়। প্রিয়তা নিজের জন্য আমার ঘরটিই বেছে নিলো। 
আমি তো মহাবিরক্ত। হতচ্ছাড়া মেয়ে! বেছে বেছে আমার ঘরটাই পেল। আমার আর শান্তি নেই। খালি প্রতিযোগিতা। উপর নিচ মিলে চৌদ্দ কামরায় কেবল আমারটায় সবার নজর। 
যাক প্রথম দিন তো কেটে গেল কোনোভাবে। আমিও তেমন ভয়ডর দেখাচ্ছি না,কারণ চিন্তা একটু অন্যদিকে বইছে আমার। ওদের কথা থেকে জানতে পারলাম ওরা বাড়িটায় কিছু পরিবর্তন করবে প্রিয়তার বিয়ে উপলক্ষে। নিচতলায় বসার ঘর, রসুইঘর আর অতিথিদের জন্য রাখা হবে। দ্বিতীয় তলায় কামরা গুলোতে ওরা থাকবে। আর উপর তলায় ঠাকুর ঘরটা ভেঙে ছাদটাকে প্রশস্ত করা হবে। মনটা দমে গেল। ঠাকুর ঘরটাই আমার একমাত্র শান্তির জায়গা ছিল। অবশ্য এখন এটা ওদের বাড়ি।
হোক ওদের কেনা বাড়ি,কিন্তু আমি ওদের এখানে টিকতে দেব না কিছুতেই। যে বাড়ির আভিজাত্যের কারণে আমায় জীবন্ত পুড়ে মরতে হলো সে বাড়ি শুধুই আমার। গত পঞ্চাশ বছরে এই বাড়িতে কেউ টিকতে পারেনি, আর কেউ পারবেও না।
এই মেয়েটা আমার ঘরে থাকা শুরু করেছে পর্যন্ত এই এক জ্বালা। এরা মা মেয়ে সারাদিন নুপুর পরে থাকে। যেদিকে যায় রুনুঝুনু রুনুঝুনু। মাথা ধরে গেল। কী আদিখ্যেতা বাবা! 
আজাহার সাহেব ঘুম ভাঙতেই চিৎকার জুড়ে দেন, কই আমার মুনিয়া পাখিটা। ও প্রিয় মামনি, ঘুম থেকে ওঠে তোর মুখ না দেখলে আমার দিন যে শুরুই হয় না। তারপর চলে আসবে মেয়ের ঘরে। এসেই মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে আস্তে আস্তে ডাকবে। মেয়ের কপালে চুমু খাবেন। 
আহা! বাবা বুঝি এমন হয়? আচ্ছা, বাবার বুকে মাথা রাখতে কেমন লাগে? একদিন প্রিয়তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে তো। লোকটা বাইরে থেকে যতবার আসেন, ততবারই মেয়ের জন্য কিছু না কিছু হাতে করে নিয়ে আসবেনই। 
প্রিয়তা ফাইন আর্টসে পড়ে। ওর বিষয় ভাস্কর্য। সারা ঘরে এখানে ওখানে টুকটাক ওর হাতের কাজের ছাপ পাওয়া যায়। 
ওদের বাবা মেয়ের আদর আহ্লাদ দেখে আমিও যেন কেমন হয়ে যাচ্ছি। কোথায় ওদের তাড়াবো উল্টো ভালো লাগতে শুরু করেছে। আগামী সপ্তাহে বাড়ি কাজ শুরু করবে। আজাহার সাহেব ছাদ সম্প্রসারণের জন্য লোকজনের সাথে কথা বলছিল। সেখানে প্রিয়তাও ছিল। আমি ইদানীং ঠাকুরঘরের আশেপাশে থাকি। যদিও এখানে ঠাকুর দেবতা কেউ অবশিষ্ট নেই,কিন্তু আমার ভালো লাগে এখানে থাকতে। ঠাকুর ঘরটা দেখে হঠাৎ প্রিয়তা বলে ওঠলো, বাবা, ঘরটা ভেঙো না। 
আজাহার সাহেব কথা থামিয়ে বললেন, কেন মা? 
প্রিয়তা ঘরটার দেয়াল ছুঁয়ে বললো, দেখো তো, এটা একসময় কত জৌলুশে ছিল। ওনারা হিন্দু ছিলেন। তাদের পূজা হতো। কত উৎসব, কত মানত,কত অভিযোগ অনুযোগ কষ্ট এখানে বলা হতো! থাক না কিছু পুরনো স্মৃতি। এখন তো আর এখানে পূজা হবে না,তো সমস্যা কোথায়? 
আজাহার সাহেব কতক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, মা, তুমি বাগান করতে চেয়েছো বলেই তো এসব। আর মুসলমান বাড়িতে ঠাকুর ঘর রেখে কী হবে?
প্রিয়তা হেসে বলে, ওটা আমার স্টুডিও হবে। আমার করা ভাস্কর্য গুলো এখানে রাখবো। এই জায়গায় একটা শান্তির ভাব আছে।
কী আশ্চর্য! মেয়ের কথায় বাবা রাজী হয়ে গেল। যাঃ বাবা! 
প্রিয়তা আমার মনের কথাগুলোই যেন বলছে। মনে হচ্ছে প্রিয়তা বলছে না আমিই বলছি, বাবা, রেখে দাও। এখানে আমি থাকি।
আমার এতো বছরের চিন্তা চেতনা সব এরা বাবা মেয়ে মিলে গুলিয়ে দিচ্ছে। আজীবন দেখে এসেছি বাড়ির পুরুষ যা বলবে তা-ই হবে। এখানে দেখি সব উল্টো। আমার মাঝে মাঝে আজাহার সাহেবকে খুব করে বাবা বলে ডাকতে ইচ্ছে করে। 

এ বাড়িতে প্রিয়তার বিয়ের কথা চলছে। সেদিন পাত্রপক্ষ এসে আংটি পরিয়ে গেল। বাবা তো মেয়ের বিয়ের আয়োজনে আত্মহারা। তার প্রথম সন্তান এবং একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। আমার অবশ্য এসব বিষের মতো লাগছে। কিন্তু মেয়েটির মুখের হাসি যেন কোথায় মিলিয়ে গেছে।  

বিয়ের মাত্র দশ দিন বাকি। পুরো বাড়িতে সাজ সাজ রব । ভর সন্ধ্যেবেলা প্রিয়তা একা দাঁড়িয়ে আছে ছাদের কার্নিশ ধরে। আমি চুপচাপ তাকিয়ে আছি ওর দিকে, যেন সেই ষোড়শী আমাকে দেখতে পাচ্ছি। এমন সময় ওর মা এসে বললো, শোন প্রিয়তা, আমি চাই না তোর বাবা এসব জানুক। এসব শুনলে লোকটা মরে যাবে। তুই কি ওর মান সম্মানের দিকে একবারও ভাবলি না?
প্রিয়তা ওর মায়ের দিকে ফিরল। সাথে আমিও। ওর চোখ বেয়ে জল ঝরছে অঝোরে। সে বলল, কাউকে ভালোবাসা কি পাপ মা? তোমরা একবারও জিজ্ঞেস করলে না বিয়েটা ঠিক করার আগে। তুমি তো জানতে, বাবাকে একবার বলে দেখতে। 
ওর মা বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, মেয়েলোকের এত আদিখ্যেতা শোভা পায় না। তোর বাবা লাই দেয় বলে আমি ওসব প্রশ্রয় দেব না। আমাদের মানসম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেব না তোকে। আমার সম্মান যে সন্তান রক্ষা করবে না, সে সন্তানের আমার প্রয়োজন নেই। প্রিয়তার মাকে দেখতে ঠিক সেদিনের আমার বাবার মতো লাগছে।
এসব কথোপকথন যেন আমার কানে গরম সীসা ঢেলে দিচ্ছিলো। চোখের সামনে যেন এতগুলো বছর পরে আগের সেই দিনটি ভেসে ওঠল। 
সেদিন এমনই এক সন্ধ্যেবেলা মেজদা'র বন্ধু অরুণ এই ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, মিনু সত্যিই কি তুই বিয়েটা করবি? তুই মাসিমাকে বলিসনি যে আমিও তোকে পছন্দ করি, তোকে বিয়ে করতে চাই? 
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, অরুণদা, তুমি জানো না আমাদের বাড়ির অবস্থা? তোমাকে এখানে আমার সাথে দেখলে বাবা জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে। আমার তোমায় ভালো লাগে ঠিক, কিন্তু বাবার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস আমার নেই। 
আমাদের কথা চলাকালে মেজদা দেখে ফেলল। মুহূর্তেই পুরো ঘরে জানাজানি হয়ে গেলো। আমার জানা ছিল না, নিচের ঘরে পাত্র পক্ষের লোক বসা ছিলেন। লোকটাকে বিদায় দিয়ে বাবা আর জেঠামশাই ছাদের ঘরে ওঠে এলেন। আমাকে আর অরুণ দা' কে সাথে দেখে রাগে চিড়বিড় করতে করতে বললেন, এসব বেলাল্লাপনা কতদিন ধরে চলছে শুনি? 
আমি ছুটে গিয়ে বাবার পা জড়িয়ে বললাম, সত্যি বলছি বাবা, আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। বিশ্বাস করুন।  
বাবা, জেঠামশাই, ভাইয়েরা আমাকে প্রচুর মারলো। অরুণ দা'কে সে রাতেই প্রচুর মারলো এবং তার পুরো পরিবারকে গ্রাম ছাড়া হতে হলো। পরদিন দুপুরে ও পক্ষের লোক এসে বিয়েটা ভেঙে দিয়ে গেল। এরপর বাড়ির লোকজন জন যেন চুপ হয়ে গেল। যেন কোনো মৃত্যুপুরী। সেদিন সারাদিন আমি ঠাকুর ঘরেই বসে ছিলাম। নিচে খুব একটা যাইনি। রাত গভীর হতেই বাবা,কাকারা এবং আমার ভাইয়েরা এলো আমার ঘরে। বাবা আমার পাশে বসে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। তারপর দুই হাতে আমার মুখটা তুলে ধরে বললেন, তোর মতো কুলটা সন্তান আমি চাই না। কেন করলি এই কাজ? 
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই ভাইয়েরা আমার দু হাত পিছনে চেপে ধরলো, আর কেউ পা চেপে ধরলো। বাবা আমার গলা চেপে ধরলো। ধীরে ধীরে সাঁড়াশির মতো আমার শ্বাসনালী চেপে যেতে লাগলো আমার বাবার দুটো হাত। যতটা না কষ্ট পেয়েছি তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছি। কীভাবে পারে একজন বাবা তার সন্তানকে নিজে মেরে ফেলতে? সন্তানের চেয়ে সমৃমান কি এতোই বড়? আমি কি আদৌ কোনো পাপ করেছি? নিস্তেজ হয়ে পড়লে হয়তো মরে গেছি ভেবে আমাকে নিয়ে ঠাকুরঘরে ফেলে রাখলো। জেঠা মশাই বড়দা আর মেজদা' র কানে কানে কী যেন বলল। একটু পরেই অনুভব করলাম তীব্র গরম। আমার সারা শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ওরা। আমি পুড়ে মারা গেলাম শুধু অকারণে। আমার সাথে এ বাড়ির ঠাকুর দেবতারাও পুড়লো।
তারপর থেকে আমি এ বাড়িতে থাকলেও মনে মনে ভেবেছি আমার জন্য বাবার মান গেছে হয়তো তাই আমার মত সন্তানকে মেরে ফেলাই উচিত। আমার মৃত্যু পর সবাই জানলো আমি ঠাকুর ঘরে পুজা করার সময় আঁচলে আগুন লেগে পুড়ে মরেছি, আমাদের ঠাকুর ঘর জ্বলে গেছে আগুনে। কিন্তু আমার মৃত্যুর পর পরই বড়দা তার পছন্দের মেয়েকে মন্দিরে সিঁদুর পরিয়ে ঘরে তুলে আনলো,কেউ কিচ্ছুটি বললো না। মেজদা নিচু জাতের এক মেয়ের সাথে নগ্ন অবস্থায় ধরা পড়লো। সেজ কাকার বাঈজী বাড়ি যাতায়াত জেনেও সবাই চুপ। তখন থেকে আমি ওদের আর এ বাড়িতে থাকতে দেইনি। আমার কোনো ভাইয়ের ঘরে সন্তান জন্মের আগেই গর্ভপাত হয়ে গেছে। বাবা, জেঠা থেকে শুরু করে ভাইয়ের বউ পর্যন্ত প্রত্যেকে অপঘাতে মরেছে, নয়তো পঙ্গু হয়েছে।
এক ঝটকায় যেন সব চোখে ভেসে ওঠলো। আজ যদি আজাহার সাহেব মেয়ের সাথে এমন কিছু করেন? ভাবতেই সারা শরীর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠলো। 
ওরা মা মেয়ের কথা কখন যে এসে আজাহার সাহেব আড়ি পেতে শুনতে পেলেন। তিনি প্রিয়তার সামনে এসে বললেন, তোর কি আর কোন পছন্দ আছে রে মা?  
প্রিয়তা মাথা নেড়ে বলে, হুম।
আজাহার সাহেব কিছু্ক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ঠিক আছে। সে কী করে?  
প্রিয়তা বলে, কলেজে পড়ায়।
আজাহার সাহেব প্রিয়তাকে বললেন ছেলেকে প্রস্তাব পাঠাতে। তারপর নিজে গেলেন বিয়ে ভাঙতে।
আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করতে লাগলাম, ভগবান, আরেকটা জন্ম দিও আজাহার সাহেবের মতো কোনো বাবার ঘরে। আমি বাবার বুকে মাথা রেখে একবার কাঁদতে চাই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন