ডা: নীলরতন সরকারকে জন্মদিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলী।

                                        সুস্মিত মিশ্র


দেশে তখন ইংরেজ শাসন,সে যুগে সাহেব ডাক্তারদের প্রবল প্রতাপে দেশীয় চিকিৎসকেরা কুঁকড়ে থাকতেন। দেশীয় চিকিৎসকদের ভিজ়িট ছিল ২ টাকা, ৪ টাকা, ৮ টাকার মধ্যে। অন্য দিকে সাহেব ডাক্তারেরা ১৬ টাকা, ৩২ টাকা, ৬৪ টাকা ভিজ়িট নিতেন। কিন্তু প্রবল স্বদেশি জাত্যাভিমান দাপুটে বাঙালি চিকিৎসকের রক্তে। চ্যালেঞ্জটা ছুড়ে দিলেন তিনিই। দেশীয় চিকিৎসক হয়েও প্রথম ১৬ টাকা ভিজ়িটে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করলেন। ব্রিটিশদের চোখ কপালে উঠল। সেই ভিজ়িট ক্রমে ৬৪ টাকায় পৌঁছেছিল! তিনি নীলরতন সরকার

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ২৫ বৈশাখ,এর ঠিক সাড়ে চার মাস পরে জন্ম নীলরতনের।এই বছরের ১ অক্টোবর দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার নেতড়াতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার আদি নিবাস যশোহর। তার পিতার নাম নন্দলাল সরকার। নন্দলাল সরকার যশোরের একটি দরিদ্র কায়স্থ পরিবারের মানুষ ছিলেন। তিনি পরবর্তী কালে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা  জেলার  জয়নগরে থাকতে আরম্ভ করেন। বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক যোগীন্দ্রনাথ সরকার নীলরতন সরকারের ভাই।

তিনি দরিদ্র রোগীদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন এবং তাদের বিনামূল্যে ওষুধ ও খাবার দিতেন। ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো এবং এরপর ফ্যাকাল্টি অফ সায়েন্স ও ফ্যাকাল্টি অফ মেডিসিনের ডিন হন। তিনি স্নাতকোত্তর কলা ও বিজ্ঞান শিক্ষা বিভাগের সভাপতিও হয়েছিলেন।

১৮৯৫ সালে তিনি একটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন করেন। ১৯১৬ সালে কলেজের নাম হয় কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ যা পরবর্তীতে আর জি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নামাঙ্কিত হয়। ১৯১৮ সালে মেডিকেল এডুকেশন সোসাইটি গঠিত হয় কারমাইকেল মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন বিষয় দেখাশোনা করার জন্য।
নীলরতন ১৯০৮ সালে বুট অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট এর নির্দেশক হয়েছিলেন। বসু বিজ্ঞান মন্দির, বিশ্বভারতী এবং ভারতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি ছিলেন । ১৯১২ থেকে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ছিলেন।

তিনি সায়েন্স কলেজ অফ দ্য ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি এবং ন্যাশন্যাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনের (জাতীয় শিক্ষা পরিষদ) স্থপতিদের মধ্যে ছিলেন। তিনি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সম্পাদক হিসাবে তিনি এদেশে বৃত্তিগত প্রশিক্ষনের চেষ্টা করেছিলেন। বেঙ্গল টেকনিক্যাল স্কুল, যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রভৃতি স্থাপনেও তার ভূমিকা ছিল। যাদবপুর যক্ষ্মা হাসপাতাল  যা বর্তমানে কুমুদশঙ্কর রায় যক্ষ্মা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় তিনি সহযোগিতা করেছিলেন।
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ছিলেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লন্ডনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় সম্মেলনে যোগদান করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিসিএল এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এলএলডি উপাধি প্রধান করেছিল।

ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় যখন মেডিক্যাল কলেজ থেকে মেডিসিনের পরীক্ষা দেন, তখন নীলরতন ছিলেন তাঁর পরীক্ষক। আজীবন তাঁদের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বজায় ছিল। নীলরতনকে গুরুর আসনে বসিয়েছিলেন বিধানচন্দ্র।
১৯০৫ সালে স্বদেশি আন্দোলনে ঝাঁপিয়েছিলেন।স্বদেশি শিল্প বিস্তারের ভাবনায় সাবান তৈরির ব্যবসা, চা ও চামড়ার ব্যবসা খুলেছিলেন। তবে ব্যবসায়ী তিনি কোনও দিনই ছিলেন না। ফলে জগদীশচন্দ্র বসুর বাবা ভগবানচন্দ্র বসু ও রবীন্দ্রনাথের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো প্রভূত লোকসান হয়েছিল তাঁর। দেনার দায়ে সাধের বসতবাড়ি বিক্রি করতে হয়। তাতেও আক্ষেপ ছিল না। বলেছিলেন, ‘‘কাজ তো আরম্ভ করা গেল, ফল আজ না হয় কাল পাওয়া যাবে। টাকাকড়ি সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন। আসে আর চলে যায়। গেলে কোনও দুঃখ নেই।’’ 

১৯৪৩ সালের ১৮ মে শুক্লা চতুর্দশীর দুপুরে অবসান হল তাঁর জীবনের। 

এই মহান মানুষটিকে তাঁর জন্মদিনে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এখন সংবাদ পরিবার

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন