সুস্মিত মিশ্র
ভারতীয় উমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির গোড়াপত্তনকারী এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। উনিশ শতকের নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং উপমহাদেশের প্রথম
এবং একমাত্র ‘র্যাংলার’হিসেবে ইতিহাসে তার একটা স্বতস্ত্র অথচ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে।কিন্তু তাকে ঘিরে আমাদের কোনো সভা-সমাবেশ নেই, নেই তার রেখে যাওয়া অবদানের স্মৃতিচারণ
কিংবা চর্চা।ইতিহাসকে পেছনে ফেলে সামনে এগোনো কখনো সম্ভব না। কারণ তারাই আমাদের জন্য বর্তমান তৈরি করে দিয়ে গেছেন, আর ভবিষ্যতের জন্য সিংহাসন তৈরি করে যেতে হবে বর্তমানকে।
আর সেটাই করে গেছিলেন আনন্দমোহন বসু।
রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক আনন্দমোহন বসু ১৮৪৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার জয়সিদ্ধি গ্রামের এক ভূস্বামী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা পদ্মলোচন বসু ও মাতা উমা কিশোরী দেবী। তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় ময়মনসিংহেই। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে মেধা তালিকায় ৯ম স্থান অধিকার করে এনট্রান্স পরীক্ষা পাশ করেন। এফএ এবং বিএ পরীক্ষা দেন।প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে। উভয় পরীক্ষায়ই শীর্ষস্থান অধিকার করেন। ১৮৭০ সালে তিনি লাভ করেন প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি। সেই বৃত্তির টাকায় ১৮৭৮ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতে পাড়ি জমান এবং দেশের জন্য বয়ে আনেন অফুরন্ত সম্মান ও সুখ্যাতি। উপমহাদেশের মানুষদের প্রতি ব্রিটিশদের দেখার চোখই বদলে দিয়েছেন হাওরের ধুলো মেখে শৈশব কাটানো এই ব্যক্তিটি।ক্যামব্রিজের মতো বিশ্বের প্রথম সারির একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতশাস্ত্রে পড়া প্রথম ভারতীয় আনন্দমোহন বসু।পরাধীন ভারতে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের জীবন বেছে নিতে বাধ্য করা হত এ দেশের মানুষকে। এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে এক উজ্জ্বল বাঙালি যুবক বুদ্ধি আর মেধায় ঘোল খাইয়েছিলেন সাদা চামড়ার মানুষদের। খোদ শ্বেতাঙ্গদের দেশ থেকে ছিনিয়ে এনেছিলেন "র্যাংলা"র
বিরল সম্মান।
র্যাংলার’শব্দটির সাথে কি আমরা পরিচিত? র্যাংলার হলো গণিতশাস্ত্রের ওপর প্রদত্ত সর্বোচ্চ উপাধি, যা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া হয়। আর এই র্যাংলার উপাধি পান আনন্দমোহন বসু। তিনিই প্রথম এবং একমাত্র ভারতীয় যিনি ‘র্যাংলার’ উপাধি পেয়েছেন। তিনি বিয়ে করেন স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর বোন স্বর্ণপ্রভা দেবীকে।রাজনীতিতে আনন্দমোহন বসু ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা ও অগ্রদূত। ছাত্রদের মধ্যে স্বদেশপ্রীতি জাগানোর উদ্দেশ্যে ১৮৭৫ সলে গঠন করে ‘স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন’। ১৮৭৬ সালে তিনি গঠন করেন ভারতবর্ষের জাতীয় কংগ্রেস এর পূর্বসূরী সংগঠন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান। ১৮৭৮ সালের ১৫ মে তিনি সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এর পূর্বে আনন্দমোহন বসু সস্ত্রীক ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্র সেনের কাছে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নেন। ১৮৭৯ সালে কলকাতায় ‘সিটি স্কুল’ স্থাপন করেন। ‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’ এর নিজস্ব ভবন নির্মাণ এবং সমাজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘সিটি কলেজ’ ও সিটি স্কুল স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
এদেশে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি ময়মনসিংহের পৈত্রিক বাড়িটি দান করে ১৮৮৩ সালে ‘সিটি কলেজিয়েট স্কুল’এর কার্যক্রম শুরু করেন। তখন এটির নাম ছিল ময়মনসিংহ ইন্সটিটিউশন উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়। তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, সিনেট সদস্য এবং শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন।১৮৭৬ সালে কলকাতায় তিনি বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে তিনি আরো ভালো ফল লাভের আশায় বেথুন কলেজের সাথে যুক্ত করে দেন।
লর্ড কার্জনের নেতৃত্বে বাংলা ভাগের চক্রান্ত চলছে তখন। এই বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করেন আনন্দমোহন বসু। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর অসুস্থ শরীর নিয়েও যোগ দেন বঙ্গভঙ্গবিরোধী জনসমাবেশে, ভাষণও দেন। এত অত্যাচার নিতে পারেনি অসুস্থ শরীর। রোগে ভুগে মাত্র ৫৯ বছর বয়সেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন পরাধীন দেশের অন্যতম বুদ্ধিজীবী।
Tags
সাহিত্য