"ভারতীয় বিপ্লববাদের জননী" মাদাম কামাকে জন্ম দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলী ।

                                   সুস্মিত মিশ্র    


দেশের স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তিতে চারিদিকে কত আনন্দ,কত ভাবে উদযাপন চলছে।কিন্তু কোথায় কি দেখা মিললো ভারতীয় বিপ্লববাদের জননীর ? জানেন কি এই জননীর কারনেই দেশ স্বাধীন হওয়ার  চার দশক আগে ইংরেজদের পতাকা সরিয়ে উড়াতে হয়েছিলো ভারতের পতাকা ? সেটা ১৯০৭ সাল।সেই বছর ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কনফারেন্সে ব্রিটেনের পতাকাকেই ভারতের জাতীয় পতাকা হিসেবে উত্তোলন করার প্রস্তুতি চলছে। এমন সময় ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এলেন এক মাঝবয়সি মহিলা।নিজের ব্যাগ থেকে একটি পতাকা বার করে বললেন, এটি হল ভারতের আসল পতাকা।বিভিন্ন দেশের অভ্যাগতদের
 সামনে আন্তর্জাতিক মঞ্চে এভাবেই দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪০ বছর আগে তিনি উত্তোলন করেছিলেন ভারতের জাতীয় পতাকা।১৯০৭ সালের ২২ আগস্ট তাঁর এমন দুঃসাহসিক কাজ প্রত্যক্ষ করেছিলেন বিশ্ববাসী।
 সেই মহীয়সীর নাম জানেন কি ? তিনি ভিকাজী রুস্তম কামা।

মাদাম কামা ১৮৬১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বোম্বাইতে একটি পারসি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, তার পিতার নাম ছিল ভিখাই সোরাব প্যাটেল। তিনি আলেকজান্দ্রা নেটিভ গার্লস ইনস্টিটিউশনে পড়াশোনা করেন।
১৮৮৫ সালে মুম্বই হাইকোর্টের সলিসিটর কে রুস্তম কামার সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। কিন্তু শীঘ্রই ইংরেজ বিদ্বেষী ও চরম পন্থায় বিশ্বাসী মাদাম কামার সঙ্গে তাঁর স্বামীর মতান্তর হয় এবং পরিণতি বিচ্ছেদে শেষ হয়

মাদাম কামা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন একমাত্র ব্রিটিশদের সম্পদ লুণ্ঠন এবং ঔপনিবেশিক দখলদারির জন্যেই ভারত দূর্ভিক্ষপীড়িত, অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল হয়ে আছে। সেই সময় থেকেই জীবনের বেশিরভাগ সময়
তিনি জনকল্যাণমূলক কাজে এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে শুরু করেন।তিনি শুধুমাত্র ব্রিটিশ শাসন থেকে মানবাধিকার এবং স্বায়ত্তশাসন লাভের জন্য লড়াই করেননি, তিনি নারী
অধিকার এবং ভোটাধিকারের জন্যও লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। ১৮৯৬ সাল নাগাদ বম্বে প্রেসিডেন্সিতে প্লেগ মহামারী রূপে ছড়িয়ে পড়ে আর তখনই প্লেগ থেকে মানুষকে বাঁচাতে গ্র্যান্ট মেডিকেল কলেজের স্বেচ্ছাসেবী দলগুলির প্রথম সারির কর্মী হয়ে ওঠেন মাদাম কামা। কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। নিজেই প্লেগ আক্রান্ত হয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু চিকিৎসার পরে সুস্থ হলেও দূর্বলতা সহজে কাটেন তাঁর। আরো ভালো চিকিৎসার জন্যে লণ্ডনে পাড়ি দেন।
 ১৯০১ সালের এপ্রিল মাসে ইংল্যান্ডে তিনি ‘ফ্রি ইন্ডিয়া সোসাইটি’ নামে একটি সমিতি গঠন করে ইংল্যান্ডে বসবাসকারী ভারতীয় তরুণ সম্প্রদায়কে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এই কাজের সূত্রে তাঁর পরিচয় হয় সর্দার সিং রাওজি রানা, শ্যামজি কৃষ্ণবর্মার মতো চরমপন্থী ভারতীয়দের সঙ্গে।১৯০৩ সালে শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা ‘হোমরুল লিগ’নামে একটি লিগ গঠন করেন।এর মুখপাত্র’ ‘ইন্ডিয়ান সোসিওলজি’ পত্রিকার অন্যতম কর্ণধার ছিলেন মাদাম কামা। ভারতবর্ষে এই পত্রিকাটি বিনামূল্যে বিতরণ করা হত। ১৯০৭ সালের আগস্ট মাসে জার্মানির স্টুগার্টে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সোসিওলজিস্ট কংগ্রেসে মাদাম কামা যোগদান করেন।এই সমাবেশেই ইংরেজদের বদলে ভারতের নিজস্ব পতাকা তুলতে বাধ্য করেছিলেন মাদার কামা। সেই বিশ্বসভাতে মাদাম কামা ভারতবর্ষের পক্ষে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা খুব হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল। বক্তৃতাকালে তাঁর হাতে ছিল ভবিষ্যৎ স্বাধীন ভারতের জন্য নির্মিত এক ত্রিবর্ণ পতাকা। তাতে ছিল
 লাল, গেরুয়া ও নীল-পরপর এই তিনটি রং। ওপরে লাল রং, তাতে আটটি আধফোটা সাদা পদ্ম, মাঝখানে গেরুয়ার ওপর দেবনারীতে লেখা ছিল ‘বন্দেমাতরম’, তলায় নীল রঙের ওপর একধারে সূর্য ও অন্যধারে অর্ধ চন্দ্র এবং তারা। সেদিন মাদাম কামার এই বক্তৃতা নিয়ে ইউরোপে ব্যাপক হইচই পড়ে গিয়েছিল।
১৯০৮ সালের ২০ নভেম্বর মাদাম কামার প্রচেষ্টায় লন্ডনের ক্যাকস্টন হলে লালা লাজপত রায়, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ নেতাদের উপস্থিতিতে এক জাতীয়তাবাদী ভারতীয় সভার ব্যবস্থা করা হয়। মাদাম কামা ব্রিটিশের দমন নীতি থেকে রেহাই পাবার জন্য ১৯০৯ সাল থেকে প্যারিসে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি এখানে থেকেই বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। এখান থেকেই তিনি গোপনে ভারতে অস্ত্রশস্ত্র পাঠানো ও ভারতীয় শিক্ষার্থীদের বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার শেখাবার ব্যবস্থা করেছিলেন।মাদাম কামা প্যারিস থেকেই কলকাতার ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকাটি পরিচালনা করতেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হলে ফ্রান্সের মাসাই-এ ভারতীয় সৈনিক দলের মধ্যে প্রচারের অভিযোগে মাদাম কামাকে প্রথমে বর্দো ও পরে ভিলিতে নজরবন্দি করে রাখা হয়।
৩৩ বছর ভারত ছেড়ে থাকার পর দেশে ফেরার অনুমতি মিলেছিল। তিনি ফিরে আসেন বম্বেতে। দেশে ফেরার মাত্র ৯ মাস পর ১৯৩৬ সালের ১৩ আগস্ট তিনি প্রয়াত হন।

হে "ভারতীয় বিপ্লববাদের জননী" আপনাকে শতকোটি প্রনাম জানায় এখন সংবাদ পরিবার

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন