দেশের প্রথম "লেজিয়ঁ দনার" দুর্গাচরণ রক্ষিতকে জন্ম দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলী।

                                      সুস্মিত মিশ্র 

'লেজিয়ঁ দনার’৷ ফরাসি দেশের এই সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মানের সঙ্গে যে ভারতীয় নামটি সবার পরিচিত, তিনি সত্যজিত্‍ রায়৷ ১৯৮৭-তে ফরাসি রাষ্ট্রপ্রধান ফাঁসোয়া  মতেরঁ স্বয়ং কলকাতায় এসে সত্যজিত-এর হাতে তুলে দেন এই পুরস্কার- ‘ন্যাশনাল অর্ডার অব্ লেজিয়ঁ দনার৷’সত্যজিত্‍ রায়ের আগে অন্তত তিন জন বাঙালি এই সম্মান লাভ করেছেন৷ এদের প্রত্যেকেই কৃতী এবং চন্দননগর ও কলকাতায় প্রসারিত কর্মজীবন এঁদেরকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা দেয়৷ ওঁরা প্রচারের আলোয় আসেননি৷এর মধ্যে ১৮৯৬
সালে প্রথম ‘লেজিয়ঁ দনার’ দেওয়া হয় যে ভারতীয়কে তিনি এক জন বাঙালি৷ তিনি দুর্গাচরণ রক্ষিত৷ ফরাসি আমলেই তাঁর নামে স্কুল তৈরি হয়- ‘একল দুর্গা’ যা দুর্গাচরণ
 রক্ষিত বিদ্যালয় নামে পরিচিত৷

১৮৪১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর চন্দননগরের লালবাগানে জন্ম হয় দুর্গাচরণ রক্ষিতের । পিতা নাম গোবিন্দচন্দ্র রক্ষিত। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ১০ বৎসর বয়সেই পিতৃহীন হন। মায়ের
তত্ত্বাবধানে বেশি পড়াশোনা করতে পারেন নি। সুতরাং মাত্র ১৪ বৎসর বয়সে পিতার কর্মস্থল 'ক্যামা ল্যামারু অ্যান্ড কোম্পানি' নামক এক ফরাসি বাণিজ্য-প্রতিষ্ঠানে সহকারী
কোষাধ্যক্ষ হিসাবে কাজ করতে থাকেন। এখানে তিনি রপ্তানি-আমদানি ব্যবসা শেখেন এবং পরবর্তীকালে চাকুরি ছেড়ে স্বাধীনভাবে ব্যবসা শুরু করেন।অল্পদিনের মধ্যেই প্রতিষ্ঠা
লাভ করেন। অবশ্য এর পিছনে ছিল তার উত্তমরূপে ইংরাজী, ফরাসি ভাষা ও গণিত শিক্ষা আর কঠোর পরিশ্রম।

চন্দননগর ও কলকাতা থেকে বিদেশে রপ্তানি হত চাল, ডাল, চা, তিল, সরষে, পোস্তদানা, তিসি ও আফিম, তসরের থান ও কাটা কাপড়৷ আর আমদানি করতেন হোয়াইট লেড্, জিঙ্ক
 হোয়াইট, কুইনাইন, ফরাসি মদ৷ সারা ভারত জুড়ে পাইকারি ক্রেতা ছিল দুর্গাচরণের ব্যবসার৷
সেবাপরায়ণতায় দুর্গাচরণ ছিলেন সকলের অনুসরণীয়৷ চন্দননগরের সবরকমের জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। তিনি প্রথম দাতব্য আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসালয় স্থাপন
করেন। দারিদ্র্যের জন্য নিজে উচ্চশিক্ষা লাভে বঞ্চিত হলেও তার শিক্ষক গোপালচন্দ্র দাসের সাহায্যে 'একল দুর্গা' নামে ছেলেদের জন্য বিদ্যালয়ের সূচনা করেন। যেটি বর্তমানে দুর্গাচরণ
 রক্ষিত বিদ্যালয় নামে পরিচিত। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে চন্দননগর 'লোকাল কাউন্সিলে'র সভ্য হন এবং ১৮৭৯ - ৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি তার সভাপতি পদে থেকে ফরাসি শাসকগোষ্ঠীকে
পরামর্শ দান করেন।চন্দননগর স্ট্র্যান্ডের উপর জোড়া-ঘাট, গঙ্গার উপর জেটি তাঁরই টাকায় তৈরি হয়৷

১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে অবৈতনিক জজ ও ম্যাজিসেট্রট হন। তার বিদ্যানুরাগের জন্য প্যারিসের ফরাসি সাহিত্য পরিষদ তাঁকে সম্মানিত সভ্যপদ Officer de Academie
অর্পণ করে পদক পাঠান। তার জনহিতকর মহান কাজ ও ফরাসি সরকারের প্রতি সুসম্পর্কের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনিই প্রথম চন্দননগরবাসী ভারতীয় যিনি ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে কম্বোজ ফরাসি
সমাজ কর্তৃক Chevalier de ordere Royale du Cambodge উপাধিতে ভূষিত হন এবং ফরাসি সরকার ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ ই জুন বহুসম্মানাস্পদ লেজিয়ঁ দনার দ্বারা সম্মানিত হন।‘লেজিয়ঁ দনার’- পুরস্কার থেকে যে অর্থ পান তা ওই সেবাতেই ব্যয় করেছিলেন বলে জানাচ্ছেন দেবীবাবু৷

মাত্র ৫৬ বৎসর বয়সে ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ আগস্ট দুর্গাচরণ রক্ষিত বসন্তরোগের কারণে পরলোক গমন করেন। ফরাসি সরকার তার পারলৌকিক ক্রিয়াতেও রাজকীয় সম্মান প্রদর্শন
করে।
দেশের মহান সন্তান দুর্গাচরণ রক্ষিতকে শতকোটি প্রনাম জানায় এখন সংবাদ পরিবার

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন