ডা: সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবন ও কাজ অবলম্বনে নাটক “এক ডাক্তারের মৃত্যু”।

কেকা মিত্র:- এই প্রথমবার বাংলার নাট্যমঞ্চে মঞ্চস্থ হলো টেস্ট টিউব বেবির জনক ডঃ সুভাষ মুখার্জীর জীবন নিয়ে দু ঘণ্টার নাটক এক ডাক্তারের মৃত্যু। ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায় সেই বিতর্কিত ডাক্তার-গবেষক, যিনি কোনোপ্রকার সরকারী সাহায্য ছাড়াই আইভিএফ পদ্ধতির মাধ্যমে জন্ম দিয়েছিলেন ভারত তথা এশিয়ার প্রথম টেস্ট-টিউব বেবি কানুপ্রিয়া আগরওয়াল ওরফে “দুর্গা”-র। এর ঠিক ৬৭ দিন আগে রবার্ট জি. এডওয়ার্ডস ১৯৭৮ সালে ২৫ জুলাই বিশ্বের প্রথম টেস্ট টিউব বেবি লুইস ব্রাউনের জন্ম দিয়েছেন।


 ডঃ সুভাষকে এই কাজে সাহায্য করেছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজির প্রফেসর ডঃ সুনীত কুমার মুখোপাধ্যায় এবং বিখ্যাত গাইনোকোলজিস্ট ডাঃ সরোজ ভট্টাচার্য। তবে তাঁর গবেষণায় নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে পাশে থেকেছেন তাঁর স্ত্রী নমিতা মুখোপাধ্যায়। তাঁরা নিঃসন্তান ছিলেন। ডঃ সুভাষ ছিলেন এন আর এস হাসপাতালের একজন চিকিৎসক। সামান্য গবেষণার পরিকাঠামোতে কোনো প্রকার সরকারি সাহায্য না নিয়ে তিনি এই গবেষণা করেছিলেন।

 দুর্গাপুজার পূর্বে ১৯৭৮ সালের ৩ অক্টোবর এশিয়ার প্রথম টেস্ট টিউব বেবির জন্ম হয়। কাগজে এবং দূরদর্শনে তিনি এই বিষয়টিকে সকলের নজরে আনেন। এই বিষয়টি জানার পর তাঁর সহকর্মীরা এবং বন্ধুরা যারা এতদিন তাঁকে অকর্মণ্য, পাগল, অকাজের মনে করতেন তাঁরা বিষয়টিকে ভালোভাবে নেননি। তাঁকে শুভেচ্ছা জানানোর পরিবর্তে তাঁর গবেষণাকে মূল্যহীন করার চেষ্টা করেছেন। সেইসব ঈর্ষাকাতর ডাক্তার ও কিছু গাইনোকোলজিস্টরা চক্রান্ত করতে শুরু করে তাঁর বিরুদ্ধে। এই কাজে জড়িত ছিলেন তাঁর কিছু বন্ধুরাও। নানাভাবে তাঁকে অপমান করতে থাকেন। সরকারি আমলাতন্ত্রও জড়িয়ে যায় এই কাজে। একটা গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে একটা তদন্ত কমিটি বসানো হয়। তাঁর গবেষণাকে নস্যাৎ করার জন্য তৈরি হয়েছিল এই কমিটি। 

কমিটিতে তাঁর গবেষণার বিষয়ে অভিজ্ঞ এমন কেউ ছিলেন না। সেই তদন্ত কমিটিতে ছিলেন মূলত গাইনোকোলজিস্ট, ফিজিওলজিস্ট এবং নিউরোফিজিওলজিস্ট। যাদের রিপ্রোডাক্টিভিটি সম্পর্কে আদৌ কোনো পড়াশোনা ছিল না। কিন্তু ডঃ সুভাষ ছিলেন একজন সোজা মেরুদণ্ডের মানুষ। সারা জীবনে কখনো আপোষ করেননি। সরকারি তদন্ত কমিটি তাঁর গবেষণাকে বোগাস ও অবিশ্বাস্য অ্যাবসার্ড বলে প্রচার করেন। তাঁকে ট্রান্সফার করা হয় বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে। এমনকি হার্ট অ্যাটাকের পর তাঁকে বিশেষ অবেদনে মেডিকেলে আই ডিপার্টমেন্ট ট্র্যান্সফার করা হয়। তাঁর গবেষণা করার সুযোগ থেকেই বঞ্চিত করা হয়। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল হরমোন কিন্তু তাঁকে আই বিভাগে নিয়ে আসা হয়। যেন গবেষণার সুযোগ তাঁকে না দেওয়া হয়। ডাক্তার নার্স এমনকি কলিগদের দ্বারা অপমানিত হয়ে তিনি ১৯৮১ সালের ১৯ জুন তাঁর ১০৭ নং সারদান এভিনিউর ফাঁকা ফ্ল্যাটে সুইসাইড করেন। এবং মারা যান।

 পরবর্তীকালে ১৯৮৬ সালে ১৬ অগাস্ট হর্ষ বর্ধন রেড্ডি ভারতের প্রথম মানব টেস্ট টিউব বেবি হিসেবে কৃতিত্ব দাবি করেন টি.সি. আনন্দ কুমার। ১৯৯৭ সালে, কুমার একটি বিজ্ঞান কংগ্রেসে অংশ নিতে কলকাতায় আসেন। সেখানেই মুখোপাধ্যায়ের সমস্ত গবেষণা নথি তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়। দুর্গার বাবা-মায়ের সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আলোচনা করার পর, কুমার নিশ্চিত হন যে আসলে মুখোপাধ্যায়ই ছিলেন ভারতের প্রথম মানব টেস্ট টিউব বেবির স্থপতি। তারপরই বিশ্বের ইতিহাসে ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব সকলের কাছে উঠে আসে।
জীবদ্দশায় মেলেনি কোনো সম্মান-স্বীকৃতি, বরং জুটেছে নিদারুণ ভর্ৎসনা। তিনি আজও রয়ে গেছেন একইরকম উপেক্ষিত, বঞ্চিত। বিলেতের অর্জিত ডিগ্রি, মানব কল্যাণের আদর্শ ও পিতার দীক্ষামন্ত্রকে সম্বল করে যিনি এই বাংলার মাটিতে বসে আবিষ্কার করেছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক নতুন পথ, বন্ধ্যাত্ব-বাঁজা ইত্যাদি শব্দের সামাজিক কলুষতা থেকে দিতে চেয়েছিলেন এক মুক্তি-আলোর সন্ধান। অথচ তাঁর সেই আবিষ্কারের কথা জনমানসে প্রকাশই পেল না সরকারের চূড়ান্ত উদাসীনতা ও অসহযোগীতায়। দিকে দিকে আজ কত ফার্টিলিটি সেন্টার, সেখানে চিকিৎসা হচ্ছে বন্ধ্যাত্বের, অথচ আজও ক’জন মানুষই বা জানি সেই চিকিৎসা-পদ্ধতির প্রথম উদ্ভাবকের কথা, তাঁর পরীক্ষালব্ধ আবিষ্কারের কথা, নিজের গবেষণার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে বন্ধু-সহকর্মী-আমলাতন্ত্র এমনকি সরকারের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর জীবনপণ লড়াই’য়ের কথা। আর একটি হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা না করে সুইসাইড করেছিলেন তিনি। তার
মৃত্যুর ৪২ বছর পর তার জীবনের নানা ঘটনা, অজানা সব কাহিনী নিয়ে গত ১০ই সেপ্টেম্বর ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে হয়ে গেল ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায় কে নিয়ে দু ঘণ্টার নাটক এক ডাক্তারের মৃত্যু। 
রবীন্দ্রনগর নাট্যায়ুধের প্রযোজনায়
এই নাটক, আবহ, মঞ্চ ও নির্দেশনায় আছেন ড. দানী কর্মকার। এই দুই ঘণ্টার নাটকে
 ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর চরিত্রে অভিজিৎ লাহিড়ী এবং তার স্ত্রী নমিতা মুখোপাধ্যায় এর চরিত্রে বর্ণালী কর্মকার অসাধারণ অভিনয় করেছেন। পাশাপাশি রাজদীপ সাহা, গৌতম কুমার রায়, অঙ্কিত সাউ, শুভ বিশ্বাস এদের অভিনয় বেশ নজর কেরেছে দর্শকদের।
কোরিওগ্রাফি তে বর্ণালী কর্মকার, পোশাকে সীমা কর্মকার, আলোতে সমর পারুই, মেকআপ এ সৌগত মিত্র যথাযথ। বহুদিন বাদে এক ডাক্তারের জীবন ঘিরে এবং তার জীবনের সত্যিকারের ঘটনা নিয়ে 
নিয়ে এই নাটক সকল নাট্যমোদী
দের নজর কারবে বলে মনে হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন